বাঙালির মহালয়া
বাঙ্গালির পুজো শুরু হয় মহালয়ার দিন ভোর ৪টায় শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এর মহিষাসুরমর্দিনী নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।তিনি ১৯০৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন।তার ডাকনাম ছিল বুশী। পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ
ভদ্র ও মা ছিলেন সরলাবালা দেবী।পিতা কালীকৃষ্ণ বহুভাষাবিদ ছিলেন এবং ১৪টি ভাষা জানতেন।বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ১৯২৬
সালে
ইন্টারমিডিয়েট
পাস
করেন।১৯২৮
সালে
কোলকাতার
বিখ্যাত
স্কটিশ
চার্চ
কলেজ
থেকে
স্নাতক
ডিগ্রিপ্রাপ্ত
হন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র থাকতেন কলকাতায় ঠাকুরমা যোগমায়া দেবীর কেনা ৭, রামধন মিত্র লেনে। ১৯৩০ সাল থেকে তিনি রেডিওর সাথে যুক্ত হন। রেডিওর প্রতি তার আলাদা একটা টান ছিলো। পূর্বে তিনি রেলওয়েতে চাকুরী করতেন। কিন্তু তাতে তার মন ছিলো না। তাই যখন রেডিও থেকে ডাক আসে,চাকরি ছাড়তে তার কোন সমস্যাই হয় নি। এমনও দিন গিয়েছে যেদিল তুমুল ঝড়-বৃষ্টির কারনে কোন আর্টিস্ট আসেননি এবং তিনি একাই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে গিয়েছেন। কখনো পিয়ানো বাজিয়ে,কখনো কবিতা আবৃত্তি কিংবা রবীঠাকুরের গান গেয়ে। ১৯৩৬ সাল থেকে তার বিখ্যাত মহিষাসুরমর্দিনী নামক অনুষ্ঠানটি শুরু করেন। যদিও এর পুর্বে বানী কুমারের লিপি ও রাইচাঁদ বড়ালের সংগীত পরিচালনায় বসন্তেশ্বরী নামক একটি অনুষ্ঠানের প্রচার করা হতো বসন্তকালের বাসন্তী পুজোর সময়। যার মধ্যে স্তোত্র পাঠ করেন স্বয়ং বানী কুমার ভট্টাচার্য। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের সফলতা ছিলো নাম মাত্র। ততকালীন অল ইন্ডিয়া বেতার নতুন করে এরকম আর একটি অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছিলো। এবং এর পরিচালনার ভার গিয়ে পরে ততকালীন বিখ্যাত শিল্পী পি.কে. মল্লিকের(পংকজ কুমার মল্লিক) কাছে। এর রচনা এবং প্রবর্তনা করেন বানী কুমার। সংগীত পরিচালনায় পি.কে. মল্লিক এবং গ্রন্থনা ও শ্লোক পাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। গায়ক ছিলেন যথাক্রমে-
- বাজলো তোমার আলোর বেণু ~ সুপ্রীতি
ঘোষ
- জাগো দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী ~দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়
- ওগো আমার আগমনী আলো ~শিপ্রা বসু
- তব অচিন্ত্য রূপ-চরিত-মহিমা~মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
- অখিল-বিমানে তব জয়-গানে ― কৃষ্ণা দাশগুপ্ত
- নমো চণ্ডী, নমো চণ্ডী ― বিমলভূষণ
- মাগো তব বিনে সঙ্গীত প্রেম-ললিত ― সুমিত্রা সেন
- শান্তি দিলে ভরি ― উৎপলা
সেন
এছাড়া অন্যান্য গান গুলি সমবেত কন্ঠে গীত হয়।
সে বছর ষষ্ঠীপুজোর দিন এই অনুষ্ঠানটি রেডিওতে প্রচার হয়। তার পরের বছর থেকে এখনো মহলয়ার দিন ব্রাহ্মমুহূর্ত থেকে এর প্রচার করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হতো। কিন্তু এর পর থেকে বর্তমান পর্জন্ত ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের রেকর্ডটিই মহালয়ার দিন ভোর
চারটের সময় সম্প্রচারিত করা হয়।
এর মধ্যে ১৯৭৬ সালে উপরমহলের বিভিন্নপ্রকার চাপের কারনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, বানীকুমার কিংবা পি.কে. মল্লিক কাওকেই না জানিয়ে আকাশবাণী কতৃক অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং তার পরিবর্তে ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী রচিত দেবীং দুর্গতিহারিনীম নামে একটি ভিন্ন অনুষ্ঠান মহালয়ার দিন একই সময়ে সম্প্রচার করে। যেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের যায়গায় শ্লোক পাঠ করেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নায়ক উত্তম কুমার। এর সংগীত পরিচালনা করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এখানে মান্না দে, লতা মাংগেষ্কর, আশা ভোসলে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পী গন গান করেন। অনুষ্ঠান সম্প্রচার শেষ হতে না হতেই কোলকাতাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আধঘণ্টার মধেই আকাশবাণী কোলকাতার অফিসের সামনে লোকজন ভির করতে থাকে এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে। অবশেষে রেডিও পক্ষ ঘোষণা দেয় যে ষষ্ঠীর দিন অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হবে। এবং তাই করা হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নিজেও হয়তো কোনদিন ভাবতে পারেন নি যে তার কন্ঠ মানুষের কাছে নস্টালজিয়াতে পরিনত হবে। তুমুল জনপ্রিয় দেড়ঘন্টার এই অনুষ্ঠানটি গত একানব্বই বছরেরও বেশি সময় ধরে সম্প্রচারিত হচ্ছে।
১৯৯২ সালে এই কিংবদন্তী দেহ রাখেন। কিন্তু জানামতে, তিনি জীবদ্দশায় এর জন্য কোন পুরস্কার বা কোন সম্মাননা পাননি। ২০০৬ সালে সারেগামা ইন্ডিয়া কৃতিত্ব স্বরূপ তার কন্যার হাতে ৫০০০০ টাকার চেক তুলে দেয়।
0 মন্তব্যসমূহ